সদ্য অনুষ্ঠিত ‘প্রবালদ্বীপে অনলাইন সাংবাদিকদের মিলনমেলা’র ‘প্রবালদ্বীপের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে এই প্রতিবেদন ছাপানো হলো। মিলনমেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে আরো যারা লেখা পাঠাতে আগ্রহী তাদেরকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে লেখা পাঠানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। প্রকাশিত লেখা থেকে তিনজনকে সেরা নির্বাচিত করে বিশেষ ‍পুরস্কার দেয়া হবে। – অধ্যাপক আকতার  চৌধুরী, আহ্বায়ক -জাতীয় অনলাইন প্রেসক্লাব ও সভাপতি- কক্সবাজার অনলাইন প্রেসক্লাব। 

শাহেদ মিজান

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ এই সেন্টমার্টিন। দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত নয়নাভিরাম এই দ্বীপটি ‘স্বপ্নের দ্বীপ’ নামে খ্যাত। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটন ক্ষেত্রে একটি বিরাট স্থান দখল করে নিয়েছে সেন্টমার্টিন। এই দ্বীপে প্রতিবছর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন। ঢেউ তোলা জীবন্ত পাথুরে সৈকত, চোখ জুড়ানো নারিকেল বীথি, খেয়াবন, জীবন্ত মাছের বারবি-কিউ, পালতোলা নৌকাসহ হরেক রকম প্রাণজুড়ানো পর্যটনের নৈসর্গিক উপসঙ্গ একাকার এই দ্বীপে। সাথে আছে ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ। মানব বসতিহীন এই দ্বীপ। তবুও লোকে লোকারণ্য খেয়াবনের ওই দ্বীপটি। সব মিলিয়ে প্রাণজুড়িয়ে দেয়া যুগলবন্দী সেন্টমার্টিন-ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ। তাই দিনে দিনে সমৃদ্ধি পাচ্ছে পর্যটনের অপূর্ব সমাহার নিয়ে সাগরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই দ্বীপটি। বছর থেকে বছরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পর্যটন সম্ভাবনা বেড়েই চলছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পর্যটনকে ঘিরে এই দ্বীপের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু অযতœ আর অবহেলায় সেই সম্ভাবনা পড়ে আছে অবলীলায়।

তথ্য মতে, সেন্টমার্টিনের পর্যটন খাতসহ অন্যান্য খাত থেকে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। কিন্তু এই দ্বীপের উন্নয়নের এর সিকিভাগও প্রচেষ্টা নেই। এমন অভিযোগ এখন সেন্টমার্টিনবাসীর। দ্বীপ রক্ষা ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেই। এতে দ্বীপের ৯ হাজার মানুষের জীবন চলছে অনিশ্চিত গন্তব্যে।

সম্প্রতি এই দ্বীপ ঘুরে এসেছেন এই প্রতিবেদক। এই পরিভ্রমণে দ্বীপের চাকচিক্যের আড়ালে থাকা অগণিত সমস্যা, দ্বীপবাসীর চাওয়া-পাওয়া ও না পাওয়ার আর্তনাদের চিত্র তুলে এনেছেন প্রতিবেদক।

দ্বীপের নানা স্থরের লোকজন জানান, পর্যটন সমৃদ্ধ হলেও এই দ্বীপের লোকজন নানা সমস্যা জর্জরিত। যোগাযোগ, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ অনেক সমস্যার সন্ধান মিলেছে তাদের সাথে কথা বলে। একই সাথে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় পেটুয়া শ্রেণির লোকজনের দৌরাত্ম্যও দ্বীপবাসীর জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। দিনে দিনে এর চিত্র ভয়াবহ হয়ে উঠছে আরো।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সেন্টমার্টিনবাসী প্রধান সমস্যা যোগাযোগ। যোগাযোগ ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা দরুণ সব ক্ষেত্রের কার্যক্রম থমকে আছে। মূল ভূখন্ড টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব সময় তিন ঘন্টা। তা কিন্তু জাহাজে। স্থানীয় কাঠের বোটে হলে লাগে পাঁচ ঘন্টার কাছাকাছি। এতে করে যেকোনো জরুরী কাজে টেকনাফ ও জেলা সদর কক্সবাজার আসতে গেলে তা কখনো সম্ভব হয় না। স্পীড বোট থাকলেও শুষ্ক মৌসুম ছাড়া তা চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এর ফলে দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হয় না। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো একটি বড় সমস্যার কথা উঠে এসেছে। তা হলো মোটা অংকের বোট ও জাহাড় ভাড়া। তার সাথে রয়েছে দু’ঘাটে চাঁদাবাজি। এতে ৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। কোন পণ্য সেন্টমার্টিনের নিতে গেলে কেনা মূল্যের কাছাকাছি টোল দিতে হয় বলে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই নিয়ে সাধারণ লোকজনের ‘বাড়াবাড়ি’ করার কোন সুযোগ নেই। তা করলে ঘাটওয়ালার প্রভাবশালীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এই রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। যার ফলে দিগুণ মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হয় দ্বীপের লোকজনকে।

দ্বীপের লোকজনের অভিযোগ, শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ অনেক সহজ ও কাছের। শাহপরীর দ্বীপের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা করা হলে সময় ও অর্থ দুটিই সাশ্রয় হবে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা তা হতে দিচ্ছে না। টেকনাফ দিয়ে ঘাট বানিয়ে তারা সেন্টমার্টিনবাসীকে একদিকে চরম কষ্টে দিচ্ছে অন্যদিকে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যোগাযোগ ও চিকিৎসা সংকট একই সূত্রে গেঁথে গেছে। বিশেষ করে মরণাপ্ন রোগীদের ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হয়ে পড়ে। দ্বীপে একটি মাত্র স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। তাতে একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের পদও রয়েছে। কিন্তু পদ থাকলেও স্মরণকাল পর্যন্ত সেখানে পা পড়েনি সেই এমবিবিএস চিকিৎসকের। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ছাগলের খোয়াড় বলে অবহিত করেন দ্বীপবাসী। ফলে একদিকে যোগাযোগ অন্যদিকে চিকিৎসক সংকট-দু-ই মিলিয়ে রোগ-শোকে মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যান এ দ্বীপের লোকজন। সময় মতো চিকিৎসা না পেয়ে অনেক মানুষের মৃত্যুর কথা জানা গেছে।
জীবন নিয়ে সদা সঙ্কিত সেন্টমার্টিনবাসী। কেননা সাগরে পানি বাড়লেই তা ধেয়ে আসে লোকালয়ে। শুষ্ক মৌসুম ছাড়া বছরের পুরো সময় ঘুর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে থাকে দ্বীপের লোকজন। এই আতঙ্কের কারণ দ্বীপ রক্ষায় নেই কোন বেড়িবাঁধ। তাই সব সময় পুরো দ্বীপ থাকে সাগরের গ্রাসে। তাই ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস আসলে আল্লাহর সহায় ছাড়া কোন উপায় থাকে না বলে জানান লোকজন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে পুরো দ্বীপ ভেসে গিয়ে অনেক প্রাণহানি হয়েছিল। সেই থেকে দ্বীপটি ক্রমান্বয়ে ভেঙে যাচ্ছে। তারপরও এখন পর্যন্ত কোন রকম বেড়িবাঁধ বরাদ্দ হয়নি এই দ্বীপের। এ নিয়ে দ্বীপের অনেক ক্ষোভ দেখা গেছে।

সেন্টমার্টিনের অনেক সমস্যার মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যা অন্যতম। সেন্টমার্টিন আধুনিক একটি পর্যটন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালেও এখনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি এই দ্বীপে। স্থানীয়ভাবে জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও তা শুধু পর্যটকবাহী কটেজ কেন্দ্রিক। সৌর বিদ্যুতের দেখা মিললেও দরিদ্রতার দরুণ অধিকাংশ মানুষ তার বাইরে রয়ে গেছে। দ্বীপে এক সময় সরকারি উদ্যোগে একটি অস্থায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও ১৭ বছর ধরে তা বিকল। জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ঘূর্ণিঝড় হারিকেনের আঘাতে এই বিদ্যুৎ জেনারেটরটি বিকল হলে তা পুন:চালুর উদ্যোগ নেয়নি সরকার। সেই থেকে অন্ধকারে রয়েছে দ্বীপবাসী। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজ, টেলিভিশন চালনাসহ আধুনিক সব প্রযুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত এখানকার মানুষ। এমনকি মোবাইল চার্জ নিয়েও মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। টাকা দিয়ে জেনারেটরের বিদ্যুতে মোবাইল চার্জ দিতে গিয়ে স্বল্প সময়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মোবাইল।

মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা। কিন্তু সেন্টমার্টিনে বসবাস করা লোকজন সরকারের শতভাগ শিক্ষার এজেন্ডা বাস্তবায়ন থেকে অনেক দূরে। এমন আধুনিক সময়েও শিক্ষা বঞ্চিত রয়েছে সেন্টমার্টিনের অনেক শিশু। জানা গেছে, ৯ হাজার মানুষের একটি ইউনিয়নে রয়েছে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাতেও রয়েছে চরম শিক্ষক সংকট। সেন্টমার্টিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে এই বিদ্যালয়ে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র ২/৩জন শিক্ষক। বেসরকারি ভাবে আরো দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও তাতেও নানা সংকট। ফলে দ্বীপের অনেক শিশু এখনো বিদ্যালয়ে যায় না। এতে নিরক্ষরতায় ধুকছে অনেক মানুষ। মূলত প্রাথমিক বিদ্যালয় সংকটের কারণেই শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় লোকজন দাবি করেছেন।

পরিবেশ রক্ষার বলী হয়ে সেন্টমার্টিনবাসী আরেক অধিকার থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত রয়েছে। জানা গেছে, সেন্টমার্টিনে রড, সিমেন্টসহ আধুনিক নির্মাণ সামগ্রী নেয়ার অনুমতি নেই। এতে করে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় বাড়ি করতে পারছে না। তবে অবাক হলে সত্য প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না ‘উদ্ভট’ এই নিয়ম। সাধারণ লোকজন না পারলেও প্রভাবশালীরা ঠিকই রড-সিমেন্টের বাড়ি করছে। একইভাবে বহুতল ভবনের নির্মাণের নিয়ম না থাকলেও প্রভাবশালীরা বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। স্থানীয়দের বাধা দিলেও বহিরাগত প্রভাবশালীদের বাধা দেয় না পরিবেশ অধিদপ্তর- এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী দ্বীপবাসী।

সেন্টমার্টিনে কোন ব্যাংকের শাখা নেই। ব্যাংক শাখা না থাকায় দ্বীপের লোকজন কোন ব্যাংক ঋণের সুবিধা পায় না। সে কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থাভাবে অনেক উদ্যোগী মানুষ ব্যবসাপাতি করতে পারেন না।

স্থানীয় সাধারণন লোকজনের অভিযোগ, দীর্ঘদিন সেন্টমার্টিন অবহেলিত থাকলেও কোন সরকার এগিয়ে আসেনি। এক্ষেত্রে দোষটা বেশি জনপ্রতিনিধিদের। স্থানীয় চেয়ারম্যান থেকে উপজেলা প্রশাসন, এমনকি কোন সংসদ সদস্যই সেন্টমার্টিন নিয়ে ভাবেননি।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহামদ বলেন, ‘একটি নীতিমালা তৈরি করে পরিকল্পিতভাবে সেন্টমার্টিন রক্ষা করতে হবে। না হয় অযতœ-অবহেলায় এই দ্বীপ একদিন হারিয়ে যাবে। তাই এই সম্ভাবনাময়ী দ্বীপকে রক্ষায় আমাদের আকুল আবেদন রইল।

তিনি আরো বলেন, ‘দ্বীপের কোনো সমস্যা সমাধানের আমরা সহযোগিতা পাচ্ছি না। বার বার আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করে যাচ্ছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ফল পাইনি।’

প্রসঙ্গত, সেন্টমার্টিন একটি ছোট দ্বীপ যা, বঙ্গপসাগরের উওর-পূর্ব অংশে এবং কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। আরবের কিছু নাবিক ২৫০ বৎসর পূর্বে এটি আবিস্কার করেন। তারা এটিকে “জাজিরা” নামকরণ করেন। ১৮৯২ সালে ১৫ জন মানুষ এই দ্বীপে বসতি শুরু করেন। বৃটিশের ওই সময়কালে এটিকে পুনরায় ‘সেন্টমার্টিন’ দ্বীপ নামে নামকরণ করা হয়। দ্বীপটির স্থানীয় নাম আবার নারিকেল জিনজিরা। এর আয়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ৭হাজার এবং বর্তমানে এ সংখ্যা ৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এর ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮৭৫ জন। সেন্টমার্টিনের সংযোযিত অংশ ছেঁড়াদিয়া। প্রধান পেশা মাছ ধরা হলেও বতর্মানে পর্যটনকে কেন্দ্র করে আরো নানা পেশার সাথে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে এই দ্বীপের বাসিন্দারা।

লেখক: শাহেদ মিজান, চীফ রিপোর্টার, সিবিএন